হানিফ সাকিব
হে মহান পিতা,
আপনি আমার জন্ম দিলেন যদি, পুত্রের স্বীকৃতি দিলেন না কেন? হ্যাঁ আমি আপনার স্মৃতিপট থেকে মুছে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেই আমি আপনাকে একদিন খুঁজে বের করে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম। আপনি আমাকে চিনলেন অতঃপর দু’চারটা লোকের সামনে স্বীকারও করলেন যে আমি আপনার সন্তান। তবে আমায় ফিরিয়ে দিলেন কেন? আমি কি ফিরিয়ে দেবার পাত্র ছিলাম সেদিন। আমার এই জয়কে আপনি এভাবে উদযাপন করলেন সেই দিন চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসেছিলাম, তবুও একটিবার পিছন থেকে ডাকলেন না, বললেন না, বাছা তুই বুকে আয়। আপনার বুকে মাথা রেখে, আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করে কাঁদবার আমার যে উনিশ বছরের বাসনা, এক নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। ধরণী কেঁপে কেঁপে ওঠে, তবুও একটিবার আপনার পাষাণ বুকটি আমার জন্য কেঁপে উঠল না। আমি ফিরে এলাম ব্যার্থ মনোরথে। এবং সেই সাথে পূর্বের থেকে আরো বেশি কষ্ট, যন্ত্রনা পেতে থাকলাম, একটা সময় ছিল না থাকার যন্ত্রনা, এবার শুরু হলো, সবকিছুই থাকার পরও অধিকার বঞ্চিত হবার যন্ত্রনা। আগে একটা মানুষের দেওয়া যন্ত্রনা পেতাম এখন শুরু হলো, গুষ্টিবদ্ধ কিছ মানুষের প্রবঞ্চনা। আমি আপনার বাড়ীর দরজাটুকু দেখার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মাতে পারি নাই বাবা!
আমার ভাঙ্গা তরী, ছেঁড়া পাল
চলবে আর কতকাল,
ভাবি শুধু একা বসিইয়া,
রে দয়াল !
এভাবে আর চলবে কতকাল।
তবে কেন সেইসব দিনে স্ত্রী সন্তান আর সংসার নামক মিছে তাসের ঘর বেঁধেছিলেন? নিজের যৌবনের উচ্ছলতায় যে ভ্রূণটি মানব সন্তান হিসেবে একটি জীবন পেল, সেই জীবনের কি কোন দাম নেই? আপনি তো কুয়েতে পারি দেবার সময় মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, নানুর কথা মতো চইলো, মন দিয়ে লেখা-পড়া কইরো, আমি ফিরে এসে তোমার সাথে দেখা করবো, স্বর্ণের চেইন নিয়ে আসবো তোমার জন্য, আমি তো শত কষ্টেও আপনার আদেশ মান্য করেছি পিতা,অথচ আপনি লিখিয়ে রেখেছেন গাদ্দারের খাতায় নাম । ছোট বেলায় স্কুলে যাইতে পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা আমার বই-খাতা কেড়ে নিতো বাবা। বিশ্বাস করেন আমার তখন স্বর্নের চেনের অভাববোধ কাজ করে নাই যা হয়েছে তা আপনি ও আপনার পরিচয়ের শূন্যতা।
আপনি কি তাহলে এমন ভেবেছিলেন যে, গার্মেন্সে চাকরি করা একটা অক্ষর জ্ঞানহীন মহিলা তার এই ছোট ছেলেটারে এমন একটা অজপাড়াগাঁয়ে রেখে বড় জোর আর কি বানাবে, হয়তো রোগে, শোকে মারা যাবে, নতুবা রিক্সা ভ্যান চালক হয়ে জিবন পার করে দিবে, তার মধ্যে তো নিজের কোন ডকুমেন্টসই আপনি রেখে যান নাই। ভাবছিলেন আপনার টিকি ধরা আর কোন ভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না এই ঘটনা তার একটা উদাহরণ নয় কি বাবা? প্রয়োজন মানুষের কাছে থেকে অনেক কিছুই করিয়ে নিতে পারে পিতা।
আজ আমি পঁচিশ বছরের যুবক। অকালে জিবনের শেষ পর্যায় চলে চলে এলাম এর দায়ভার কার কাছে দেই পিতা! পিতার ছাঁয়া আর মমতায় বেড়ে ওঠে পুত্র, আমার ছাঁয়া কোথায়? পরগাছা হয়ে এই নষ্ট জিবনের ভবিষৎ কি আমার? আপনি বলে দেন। একটি শিশুর জন্ম দিয়ে তাকে কেন অন্ধকারের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন? মানুষ ভুল করে তাই বলে ফুলকে পিষে মারার অধিকার স্রষ্টা আমাদের হাতে দিয়েছেন কি পিতা। আমি কেন আজ আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত? আজ আপনি প্রতিষ্ঠিত সমাজপতি, হাজী সাহেব, (স্ব-স্ত্রীক), মুক্তিযোদ্ধা, ও দেশের একজন গর্বিত অবসর সেনাসৈনিক আর আমার কোন সমাজই নেই? সামাজের কাছে কেন আমার মিথ্যে মিথ্যে পিতৃহীন পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে? জন্মই কি আমার আজন্ত পাপ? সত্যিই কি আমি একটা দুর্ঘটনা! তবে কেন এই শাস্তি আমাকে মাথা পেতে নিতে হবে? আপনার কাছে এই প্রশ্ন রাখলাম।
জেনেছি আপনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। দেশ মাতৃকাকে ভালবেসে নিজের জিবনকে বাজি রেখেছিলেন। দেশমাতার সম্ভ্রম রক্ষার্থে যে আপনি সেইদিন অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন নিজের হাতে, সেই হাতেই কেন আমার মায়ের সম্ভ্রম লুটে নিলেন সেই সাথে বিশ্বাস? রংপুরের একটা অসহায় নারী আপনাকে বিশ্বাস করে আপনাকে তার সকল কিছুর অভিভাবক বানিয়েছিলেন, সে সারাজিবন কি পেলেন আপনার থেকে? প্রবঞ্চনা! আপনার অতীত আপনাকে কখনোই কি তাড়া করে না? কেনইবা নিজের ঔরসজাত সন্তানের জন্য আপনার বিন্দুমাত্র আবেগ ভালবাসা কাজ করলো না? তাহলে কি এটাই সত্য যে, “একজন রাজাকার আজিবন রাজাকার, একজন মুক্তিযোদ্ধা বার বার মুক্তিযোদ্ধা নয়।
আমি তো আপনারই সন্তান, আপনার ঔরসজাত, তবে কেন নিজের সাথেই বা কেন এই প্রবঞ্চনা? আপনি যখন আয়নার সামনে দাঁড়ান, তখন কি শুধু এক প্রতারকের মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে না? আপনি মুখ লুকান কি করে?
আর কত দিন এভাবে চলবে? আপনার কি মুক্তি লাভের কোন আকাঙ্ক্ষা নেই? একটিবার নিজের মনুষ্যত্ব প্রমানের সুযোগটুকু নেবার একটুকু বাসনা নেই আপনার? হাশরের ময়দানে আপনি কি জবাব দেবেন? যখন জানতে চাইবে আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী আর সন্তানের কথা? আপনি কি মনে করেন, হজ্জ করে এসে আপনার অতীতের সকল পাপ, আপরাধ মাফ হয়ে গেছে? হাজী হলেই সব কিছু হাসিল? যৌবনে মানুষ বুনো ঘোড়া!! শেষ বয়সে অর্থ আর প্রতিপত্তির দাম্ভিকতায় মক্কা গিয়ে অক্কা পাওয়ার বাসনা রাখলেন! শত অনুরোধেও একবারে জন্য রংপুর এসে আমার মাথাটা একটু সোজা আর উচু করে দিয়ে যেতে পারলেন না! বয়সের অযুহাতে,অথচ (স্ব-স্ত্রীক) মক্কা চলে গেলেন! আমি কি জানি নাই আপনার এই সার্টিফিকেট অর্জনের সুখবরটা? সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম পিতা, নিজের ভিতরের আগুনটারে একটু একটু করে জালিয়ে তুলেছি, কেবল শেষটা দেখবো বলে এই আশায়। সত্যিই কি নিষ্পাপ শিশুর মতো পবিত্র হয়ে গেছে আপনার শরীর, প্রতিটা লোম পিতা!? আপনি কি টের পান! আমি যেভাবে পাই?
একটা কিছু করুন।
এভাবে আর কতদিন চলবে?
দিন ফুরালে হাসবে লোকে,
আমাদের এই দুঃসময়ে আপনি কিছু বলুন,
একটা কিছু করুন।
“Papa was a Motherfucker”
দয়া করে আমার জিবন থেকে এ দর্শন মুছে ফেলায় সাহায্য করুন পিতা। এ আহ্বান শুধু আমাদের জন্য নয় বরং আপনার পরকালের জন্য সঞ্চিত হোক কিছু পুণ্য।
নিজের ঔরসজাত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নিতে কতটা মানুষ হতে হয় আপনি আমাকে শেখান । আমি তো আপনার কোন অবৈধ সন্তান নই তবুও কেন আমার এই নোংরা পরিচয় । আমার আর আমার মায়ের প্রতি এই অন্যায় অবিচারে আপনার নিজেরও কি প্রাপ্তি? আপনিও কি অনুশোচনায় ভোগেন?